“এটাই কি তাঁর আসল চাল?” (Is This the Trick Up His Sleeve?)

“এটাই কি তাঁর আসল চাল?” (Is This the Trick Up His Sleeve?)


এক বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ

নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তা ছিল শুধুই একটি প্রশাসনিক স্থানান্তর নয়—বরং তা ছিল একটি সূক্ষ্ম কিন্তু সুগভীর রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত। তাঁর অভিসন্ধি হয়তো কেবলমাত্র একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করানো নয়; বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং শাসন কাঠামোকে নব্য সংজ্ঞায়িত করার একটি কৌশলী প্রয়াস—যেটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নয়, বরং সামাজিক ব্যবসা, এনজিও নেটওয়ার্ক, এবং ডিজিটাল প্রভাব খাটানোর শক্তি ব্যবহার করে কার্যকর করা হতে পারে।

এই কৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত ধারণা—বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০০ থেকে ১০০০টি সামাজিক উদ্যোগ বা এনজিও গড়ে তোলা, যাদের প্রত্যেকটি কমপক্ষে ১ লক্ষ মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এই হিসাবে, ড. ইউনূস এক বছরের মধ্যে প্রায় ১ কোটি নাগরিককে একটি বিকল্প এবং নন-পার্টিজান কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারেন। এটি হবে একটি ধীরগতির কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর ‘হাইভ মাইন্ড’ বা সমবেত প্রভাব বিস্তারকারী কাঠামো, যা কেন্দ্রনির্ভর নয়, বরং বিকেন্দ্রীভূত আস্থার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে।

এবার এই পরিকল্পনার পরবর্তী স্তরে আসা যাক—ড. ইউনূসের নতুন উদ্যোগ “Social Business Plus” মডেল। এটি তার পূর্ববর্তী সামাজিক ব্যবসার একটি পরিপূর্ণ রূপান্তর, যেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তথ্য বিশ্লেষণ, ডিজিটাল সমাধান, তরুণদের মোবাইল অ্যাক্টিভিজম, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রসারে এআই ও অ্যালগরিদমের ব্যবহার। এটি আর শুধু ঋণ বা আত্মনির্ভরশীলতা নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক অধিকারভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে সমাজকে পুনর্গঠনের একটি টেকসই কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।

এই কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে তার পূর্ব প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক—বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল অপারেটর। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তিনি তথ্য, আচরণগত বার্তা, নাগরিক সচেতনতা, ও নৈতিক কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে একটি “ডিজিটাল অভ্যাস” বা behavioural pattern, যেখানে ইউনূসের আদর্শে গড়ে ওঠা বার্তা প্রতিনিয়ত জনগণের কাছে পৌঁছায়, নীরবে কিন্তু শক্তভাবে তাদের মানসিকতা গঠনে প্রভাব ফেলে।

এই প্রক্রিয়াটি কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের আওতায় নয়, বরং এক ধরনের নৈতিক আন্দোলনের ছায়ায় গড়ে ওঠে। জনগণ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না করলেও, তারা এমন একটি পরিসরে নিজেকে আবিষ্কার করে যেখানে ইউনূসের ধারণা ও কার্যক্রমই তাদের জীবন ও চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।

নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ২০২৬ সালের নির্বাচনের সময় এই কাঠামো কার্যকর থাকলে, ১ কোটি মানুষের এই নেটওয়ার্ক ভোটব্যাংকের মতো কাজ করতে পারে—তবে প্রচলিত অর্থে নয়। এটি হবে সেবা ও আস্থার ভোট, যা রাজনৈতিক জবাবদিহিতার চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে।

তবে এই কৌশল ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এনজিওদের রাজনৈতিক রূপ দেওয়া তাদের নিরপেক্ষতা নষ্ট করতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আচরণগত প্রভাব বিস্তার অনেকের কাছে নজরদারি বা “সফট কন্ট্রোল”-এর ইঙ্গিতও দিতে পারে। এমনকি সামরিক ও রাজনৈতিক মহল এই বৃদ্ধিমান প্রভাব বিস্তারকে হুমকি হিসেবেও দেখতে পারে।

তারপরও, এটি একটি নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রনীতি কৌশল—সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে গঠিত বিকল্প শাসন কাঠামো, যেখানে ক্ষমতা আসে বিশ্বাস, সংযোগ এবং ডিজিটাল অভ্যেসের মাধ্যমে। ড. ইউনূস হয়তো সরাসরি ভোটে দাঁড়াবেন না, কিন্তু এই কাঠামোর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে ফেলবেন—একটি নীরব বিপ্লব, যা মিছিল বা বক্তৃতার মাধ্যমে নয়, বরং পরিসেবা, নৈতিকতা এবং ডিজিটাল কাঠামোর মাধ্যমে গড়ে উঠবে।

সত্যিই কি এটাই তাঁর লুকানো চূড়ান্ত চাল?

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *