বিদ্রোহের ছায়া: স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গোপন রাজনৈতিক ইতিহাস

বিদ্রোহের ছায়া: স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গোপন রাজনৈতিক ইতিহাস

 আগুনের শুরুঃ আদর্শের নামে সন্ত্রাস

যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু শান্তির কোনও চিহ্ন ছিল না।

১৯৭৩ সালের দিকে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল—খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা, ও রাজশাহী—ছিল ভেতরে ভেতরে এক অস্থির আগ্নেয়গিরি। আমি তখন কিশোর, চোখে নতুন দেশের স্বপ্ন, কিন্তু চারপাশে ছিল বিভীষিকা, রক্ত, ষড়যন্ত্র আর গোপন বিদ্রোহ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ তখনও জায়গায় জায়গায় পড়ে ছিল—গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের ক্ষত তখনও দগদগে। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মাঝেই জন্ম নিল এক নতুন ধরণের যুদ্ধ—একটি আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী যুদ্ধ যা দেশকে বিভক্ত করল ভেতর থেকে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (EPCP) এবং নকশালপন্থীরা—তিনটি ভিন্ন ধারার গোপন রাজনৈতিক গোষ্ঠী—তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এদের কেউ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর, কেউ বা চীনা বিপ্লবের অনুসারী, আবার কেউ ছিল নিছক লুটপাট ও শক্তি কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে গঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।

জাসদ-এর শুরুর ভাষ্য ছিল “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”, কিন্তু বাস্তবে তাদের কার্যক্রম ছিল হিংসাত্মক এবং বিভ্রান্তিকর। রাজনৈতিক হত্যা, চাঁদাবাজি, ব্যাংক ডাকাতি, জেল ভেঙে বন্দী ছিনতাই—এসবই তখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

EPCP ছিল চীনপন্থী, কিন্তু তাদের মধ্যে এক ধরনের পাকিস্তানি সামরিক ভাবধারা ছিল। তারা কি আদৌ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ মেনে নিয়েছিল? নাকি এটা ছিল পাকিস্তানপন্থীদের ছদ্মবেশী পুনরাবির্ভাব?

নকশালপন্থী আন্দোলন, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছড়িয়ে পড়া, সীমান্তবর্তী জেলা যেমন কুষ্টিয়া ও রাজশাহীতে তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা তরুণদের ‘বিপ্লবী’ বানানোর জন্য হোস্টেল, কলেজ এবং গ্রামের চায়ের দোকানগুলোকেও ব্যবহার করত।


পর্ব ২: প্রতিরোধ না প্রতিশোধ? রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের সন্তানরা

এই গোপন বিদ্রোহ শুধু খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী জেলায়।

কুষ্টিয়াতে EPCP গ্রামের ভেতরে ঘাঁটি গড়ে তোলে। তারা ‘জন আদালত’ বসিয়ে ‘শ্রেণিশত্রু’দের শাস্তি দিত। পাবনাতে ছাত্রদের জোর করে দলে ভেড়ানো হতো। নাটোরে, আওয়ামী লীগ নেতা হত্যাকাণ্ড। রাজশাহীতে, অধ্যাপক হত্যা—সবারই পেছনে ছিল আদর্শের নামে দমন।

রাষ্ট্র জবাব দেয় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জারবি) দিয়ে। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তারা গ্রেপ্তার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নেয়। এতে রাষ্ট্র আর বিদ্রোহীর মধ্যে পার্থক্য সাধারণ মানুষের চোখে ঝাপসা হয়ে যায়।

এক চাষা বলেছিলেন:
“জমিতে ফসল ফলাই—কিন্তু কে নিয়ে যাবে জানি না। একবার জাসদ, আরেকবার জারবি!”


পর্ব ৩: উত্তরাধিকার—এক প্রজন্মের ক্ষোভ, আরেক প্রজন্মের উগ্রতা

এই দমননীতি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। যারা এক বছর আগেও দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল, তাদের রাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখে। চাকরি নেই, স্বীকৃতি নেই, আর এখন রাষ্ট্রের চোখে তারা ‘ঝুঁকি’।

পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অভিযানে অনেকেই মনে করেন—এই প্রতিক্রিয়া ছিল অতিরিক্ত কঠোর। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন:
পাকিস্তানি সেনা ভাবধারা কি নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে কোথাও গোপনে বাসা বেঁধেছিল?
তাদের কি উদ্দেশ্য ছিল নতুন সরকারকে ব্যর্থ করা? এই প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবই হয়তো বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল।

ফলে নতুন এক শূন্যতা তৈরি হয়—আদর্শগত, সামাজিক ও মানসিক। সেই শূন্যতা পরে পূরণ করে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। যারা সমাজতন্ত্রে ভরসা হারায়, তারা পরে আশ্রয় নেয় ধর্মীয় উগ্রবাদে।

এইভাবেই, একটি প্রজন্ম যারা রাষ্ট্র গড়েছিল, তারা অবহেলিত হয়। আর একটি প্রজন্ম, যারা সেই তিক্ততা নিয়ে বড় হয়েছে, তারা হয়ে ওঠে বিদ্রোহী, বিভ্রান্ত, আর কখনও কখনও চরমপন্থী।


উপসংহার: গভীর ষড়যন্ত্র, না কি পরাজিতদের প্রতিশোধ?

এই বিশৃঙ্খলার পেছনে কি শুধুই ভুল নীতিনির্ধারণ? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে ছিল সুপরিকল্পিত এক গভীর ষড়যন্ত্র?

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সরকার আদর্শিকভাবে দৃঢ় ছিল, কিন্তু বাস্তবতা অনুধাবনে দুর্বল। একদল-নির্ভর শাসন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, প্রশাসনিক দুর্বলতা—এসবই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ যখন পুনর্গঠনের চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন বিদ্রোহের বীজ ছড়ানো হচ্ছিল পরিকল্পিতভাবে

অনেকে বিশ্বাস করেন, এই বিদ্রোহ ছিল একটি ‘ডিপ স্টেট’ প্রকল্প—পরাজিত পাকিস্তানপন্থী চক্রের শেষ চেষ্টা। EPCP-এর চীনা পক্ষপাত, জাসদের হঠাৎ উত্থান, নকশাল অনুপ্রবেশ—এসবই কি নিছক কাকতালীয়?

অথবা, এটি কি ছিল পরাজিত শক্তির প্রতিশোধের পরিকল্পনা—যারা সরাসরি লড়াইয়ে হেরেছিল, কিন্তু আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল?

হয়তো উত্তরটি দুইয়ের মিশ্রণ।

কিন্তু এক জিনিস নিশ্চিত—এই দমননীতি, আদর্শগত বিভাজন এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সেই ক্ষত আজও ভোলেনি।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *