বাংলাদেশ — ভূ-খণ্ডের দিক থেকে ক্ষুদ্র, কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উর্বর মাটি এবং বর্ণিল সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই সুন্দর দেশের বুকেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এক অদৃশ্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে: এত ছোট দেশে এত বড় জনসংখ্যা কি সত্যিই সাস্টেনেবল?
জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাস্তবতা ও বিপর্যয়
২০২৫ সালের প্রাক্কালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ছুঁয়েছে। এই হিসাব প্রতি বছর প্রায় ১.৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সময় এ দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭.৫ কোটি। মাত্র পাঁচ দশকে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে।
দেশের আয়তন মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে প্রায় ১,১৫০ জনের বেশি মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। শহরগুলোতে এ সংখ্যা ভয়াবহ রূপে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা—সব শহরেই জনসংখ্যার চাপে জীবনযাত্রার মান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এই ঘনবসতির ফলে প্রথম যে সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে ওঠে তা হলো—
-
চাকরির অভাব: প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়; বেকারত্বের হার বাড়ে।
-
অভাবনীয় দারিদ্র্য: জনসংখ্যা বাড়লেও আয়ুপাতের হারের মতো অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে না।
-
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সঙ্কট: স্কুল ও হাসপাতাল যথেষ্ট নয়। অনেক শিশু স্কুলে যায় না, রোগে ভুগে অকালেই ঝরে যায় জীবন।
-
ভূমি সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়: কৃষিজমি নগরায়নের কবলে। বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী ভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
নগরায়ন ও নগরের বোঝা
ঢাকা শহর ইতিমধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে। রাস্তায় জ্যাম, বস্তি ও বর্জ্য পাহাড়ের মতো সমস্যা। স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব, বিশুদ্ধ পানির সংকট, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি—সবকিছুর মূলে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা। শহরপ্রীতি নয়, বরং গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা মানুষের ঢলেই নগরজীবন দম বন্ধ করা হয়ে উঠেছে।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: বড় জনসংখ্যার টানাপোড়েন
বাংলাদেশের মাটি উর্বর হলেও তা দিয়ে এতো মানুষের মুখে ভাত তুলে দেওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, বাংলাদেশের কৃষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াচ্ছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্য ঘাটতি ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে।
কৃষিজমি ক্রমশ কমছে, বন্যা-খরা-জলবায়ু পরিবর্তন বাড়ছে, কৃষি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, কৃষির ওপর এককভাবে নির্ভর করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় সীমাহীন চাপ
দেশের স্বাস্থ্যখাতও এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে নুয়ে পড়ছে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই, ডাক্তার-নার্সের সংকট। স্বাস্থ্যসেবার মানের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মানও হুমকির মুখে।
শিক্ষা খাতও একইরকম। স্কুলের ক্লাসরুমগুলোতে জায়গা নেই। শিক্ষক সংকট প্রকট। শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দক্ষ জনবল তৈরি হওয়ার পরিবর্তে দেখা দিচ্ছে এক প্রজন্মের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি
বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ নিচু এলাকার বাসিন্দা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বছরে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এই মানুষগুলো কোথায় যাবে? বাঁচার লড়াইয়ে তারা আরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির বৃত্তে ঢুকে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের চাপ বাংলাদেশের জনসংখ্যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে।
সাস্টেনেবল উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) অর্জনে বাঁধা
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) অর্জন করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পরিবেশ—সব ক্ষেত্রেই এই চাপে কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে।
যখন জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল সমাজের সব স্তরে পৌঁছায় না। বাংলাদেশের এই অবস্থা SDG-এর মূল দর্শনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।
সমাধানের পথ কী?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাধান কী? কয়েকটি মৌলিক বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি:
✅ প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হলো পরিবার পরিকল্পনা। সরকার ও বেসরকারি সংস্থা মিলে সচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজলভ্য করতে হবে।
✅ নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার প্রসার: পড়াশোনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সচেতন নারী সমাজ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
✅ কৃষির আধুনিকায়ন ও টেকসই শহর পরিকল্পনা: কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। একইসাথে, শহরগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে।
✅ জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে।
✅ দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা: রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। জনসংখ্যা নীতি হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত, বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার এই অস্থিরতা বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। বাংলাদেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ নতুন জনসংখ্যা যুক্ত হচ্ছে, অথচ দেশের ভূমি, খাদ্য, পানি ও অন্যান্য সম্পদ সীমিত। যখন এই সম্পদের ঘাটতি তীব্র হয়, তখন মানুষ বাঁচার তাগিদে অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সীমান্তে অভিবাসন সংকট
ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের ওপারেই আছে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যখন খাদ্য সংকট, কাজের সংকট ও আবাসনের সংকট তীব্র হয়, তখন সীমান্ত পারাপারের ঘটনা বাড়ে।
এখনও সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি ভারতে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশি অভিবাসীরা ভারতের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে এবং অনেক সময় স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে বাংলাদেশি অভিবাসীরা তাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংঘাতের ভয়
যে হারে বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারতে প্রবেশ করছে, তাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যার ভারসাম্যও পরিবর্তিত হচ্ছে। আসামে বহু জায়গায় ‘অসমীয়ানত্ব’ হারিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও দেখা দিয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। শরণার্থী সঙ্কটের মতো করে দেখা দিচ্ছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রবাহ। এই কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে।
অর্থনৈতিক চাপ
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যদি বৃহৎ অভিবাসী ঢল শুরু হয়, তাহলে ভারতসহ আশেপাশের দেশগুলোর শ্রমবাজারে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সীমিত হয়ে যাবে, স্থানীয় শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।
নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি
আরেকটি বড় শঙ্কা হলো নিরাপত্তা ঝুঁকি। যখন সীমান্তে অবৈধ পারাপার বাড়ে, তখন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ও চোরাচালানকারীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা থেকে যে বিশাল ‘বেকার যুবকবাহিনী’ তৈরি হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ সহজেই জড়িয়ে যেতে পারে অবৈধ কর্মকাণ্ডে। এতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
ভারত ইতোমধ্যেই সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে। কিন্তু এই অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা স্রোত সামলানো সহজ নয়। এতে দুই দেশের সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংকট
মিয়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের সীমান্ত আছে, যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট প্রকট। বাংলাদেশের জনসংখ্যার চাপ ও মানবিক সঙ্কটের কারণে মিয়ানমার সীমান্তেও অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়নের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে যদি বাংলাদেশের ভেতরেই ‘অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু’ সৃষ্টি হয়, তাহলে এরা মিয়ানমারের দিকেও নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বিরোধ
অতিরিক্ত জনসংখ্যা আঞ্চলিক সহযোগিতা নষ্ট করতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একসময় যে নদীজল, সীমান্ত ব্যবসা, বাণিজ্যিক সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল, তা এখন সীমান্তে জনসংখ্যা সঙ্কট ও অভিবাসন ইস্যুর কারণে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আস্থার অভাব বাড়ছে, পারস্পরিক সম্পর্ক জটিল হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভারসাম্য ভেঙে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত না করতে পারলে এই জনসংখ্যা স্রোত ভারত, নেপাল, মিয়ানমার—সবক’টি দেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা শুধু দেশের ভেতরেই নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্যও এক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের জনসংখ্যা সংকটের সমাধান শুধু দেশীয় উন্নয়নের জন্য নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
উপসংহার: স্থিতি না হলে সমাধান নেই
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এই গতিতে বেড়ে চললে আগামী দিনে খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য—সবকিছুতেই চরম সংকট দেখা দেবে। ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এত মানুষের চাপ কেবল প্রাকৃতিক সম্পদই নয়, সমাজের স্থিতি ও নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আমরা যদি আজকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই দমবন্ধ করা প্রবণতা রুখতে না পারি, তাহলে একদিন আমাদের সুন্দর বাংলাদেশ হয়তো জীবিকার দিক থেকে অচল হয়ে পড়বে। জনসংখ্যা হবে সমৃদ্ধির হাতিয়ার, না সমাজের বোঝা—সেটা আমাদের সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগের ওপর নির্ভর করছে।
সময় এসেছে—এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এত বড় জনসংখ্যা সত্যিই সাস্টেনেবল নয়, যদি না আমরা এখনই পরিবর্তন আনি।