📖 ভূমিকা: প্রেম, প্রতিরোধ ও পাহাড়ের রক্তাক্ত রূপকথা
আমরা যখন প্রেম নিয়ে কথা বলি, তখন হয়তো চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলকাতা শহরের মেঘলা দুপুর, কিংবা ঢাকা শহরের রিকশার ফাঁকে ফাঁকে কিশোর প্রেমিকের চুম্বনপ্রসূত স্বপ্ন। কিন্তু যদি সেই প্রেম হয় পাহাড়ি গহীনে, গুলির আওয়াজে, রক্তাক্ত ছিন্নবস্ত্র শরীরে, ক্যাম্প ফায়ারের আলোর পাশে? যদি সেই প্রেমের গল্প হয় এক যুবক সাংবাদিক-গুপ্তচর আর এক পাহাড়ি গেরিলা নেত্রীর মধ্যকার এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতা?
এই উপন্যাস, “Espionage Romantic Thriller”, ঠিক তেমন এক গল্প—যেখানে প্রেম শুধুমাত্র শরীর ছোঁয়ার খেলায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিরোধের এক পরাকাষ্ঠায় রূপ নেয়। যেখানে যৌনতাও বিদ্রোহের ভাষা হয়ে ওঠে, আর ভালোবাসা হয়ে দাঁড়ায় অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র আশ্রয়।
১. উপন্যাসের জন্ম
এই উপন্যাসের বীজ রোপিত হয়েছিল এক অস্পষ্ট ভাবনায়:
“কী হয় যদি গুপ্তচরবৃত্তি, সাংবাদিকতা, প্রেম, সেক্স এবং সশস্ত্র রাজনীতি এক জায়গায় এসে মিশে যায়?”
কিন্তু লেখার সময়, আমি উপলব্ধি করলাম, এটি শুধুমাত্র একটি অ্যাডভেঞ্চার গল্প নয়—এটি একটি চেতনার যাত্রাপথ, একটি বিবেকের বিবরণ।
প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে বাস্তব রাজনীতির ছায়া, নারীকে শুধুই ভোগ্য না দেখিয়ে লড়াকু, আত্মমর্যাদাশীল চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাও।
২. চরিত্র ও তাদের স্তর
মুন্না—একজন তরুণ, অনুসন্ধিৎসু, যৌবনে দীপ্ত, বোহেমিয়ান সাংবাদিক, যার অতীত ঘিরে রয়েছে বাংলাদেশ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি স্মৃতি। তার মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা দৃষ্টিভঙ্গি, আবার প্রেমিকের কোমলতা। সে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শেখা সারভাইভাল স্কিল দিয়ে পাহাড়ে বাঁচে, আবার একইসাথে নারীসঙ্গ, প্রেম আর কামনায় নিজেকে খুঁজে পায়।
লুম্বিনি—এক পাহাড়ি কিশোরী থেকে এক চেতনাসম্পন্ন, সশস্ত্র বিপ্লবীর রূপান্তর যার অস্ত্রের চেয়েও ধারালো তার দৃষ্টি। লুম্বিনি একাধারে ‘অগ্নিকন্যা’ আবার এক কোমল, প্রেমপিপাসু নারী। সে প্রেমে পড়ে, শরীর দিয়ে ভালোবাসে, আবার নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লব তৈরি করে।
তাদের প্রেম না conventional, না সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
তাদের সম্পর্ক আদতে এক ‘বিপ্লবী কামনা’—যেখানে যৌনতা নষ্ট নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রকাশ।
৩. প্লটের পথরেখা
গল্প শুরু হয় পাহাড়ি এলাকায় শান্তি বাহিনীর গোপন ঘাঁটি পরিদর্শনের ছুতোয়।
তারপর ধীরে ধীরে পাঠক প্রবেশ করে এক গুপ্তচর-সাংবাদিকের দৃষ্টিকোণে—যেখানে সে প্রেমে পড়ে যায় এক বিপ্লবী নারীর, এক ‘বিপজ্জনক ফ্যান্টাসি’-তে।
আস্তে আস্তে সেই প্রেম রূপ নেয় শরীরের গহীনে, তাদের যৌনতা হয়ে ওঠে বন্য, প্রাণখোলা এবং লালিত প্রতিরোধের এক রূপ।
কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
বার্মিজ সেনা ও পরাজিত পাকিস্তানি ঘাতকদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক মিলিশিয়া হামলা চালায় লুম্বিনির ঘাঁটিতে।
তারা বন্দি হয়, শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়, আর তখনই আসে এই উপন্যাসের সর্বোচ্চ বেদনাদায়ক এবং সাহসী অংশ—৬ দিন ধরে ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলা হয় তাদের শরীর, কিন্তু মরে না তাদের চেতনা।
ঠিক যখন পাঠক ধরেই নেয় সব শেষ, তখন হঠাৎ উঠে আসে রামথাংগা, এক কিশোর যার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন।
সে তাদের উদ্ধার করে। শুরু হয় পালানোর যাত্রা—মৃত্যুর মুখে মুখে হাঁটা।
শেষত, আইজলে তারা পৌঁছে দেয় ক্যামেরাবন্দি সত্য, আর সেই মুহূর্তে সারা বিশ্ব থমকে যায়।
৪. উপন্যাসের গভীর স্তর
এই উপন্যাসে অ্যাডভেঞ্চার আছে, কামনা আছে, রাজনৈতিক প্রতীক আছে, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে তিনটি থিম—
১. যৌনতা ও নারীকে কেন্দ্র করে নির্মিত প্রতিরোধ
২. রাষ্ট্র ও কর্পোরেট আগ্রাসনের মুখে আদিবাসী অস্তিত্বের লড়াই
৩. ভালোবাসার চরম রূপ—যেখানে শরীর, মন, এবং মৃত্যু একসাথে ঘামতে থাকে
মুন্না ও লুম্বিনির প্রেম নিছক রোমান্স নয়। এটা এমন এক প্রেম যা ভয়কে তুচ্ছ করে, যা বন্দি অবস্থায় ‘আমি বেঁচে আছি’ বলার সাহস দেয়।
৫. কেন এই উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ?
যুগ পাল্টেছে। এখন আমরা এক বহুমাত্রিক দুনিয়ায় বাস করি।
যেখানে প্রেম আর প্রতিরোধ, যৌনতা আর যুদ্ধ, সাংবাদিকতা আর গুপ্তচরবৃত্তি—সব একে অপরের পাশে দাঁড়ায়।
এই উপন্যাস তারই সাহসী চিত্র।
এটি একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্মের মানসিক পটভূমি, অন্যদিকে আদিবাসী নারীর কণ্ঠস্বর, আবার আরেকদিকে গ্লোবাল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বাস্তবতা—সব মিলিয়ে এক সমকালীন রাজনৈতিক রূপকথা।
পাঠকের প্রতি
আপনি যদি এই বইটি পড়তে এসে কেবল প্রেমের গল্প আশা করে থাকেন, তবে আপনি মুগ্ধ হবেন।
আপনি যদি এডভেঞ্চার চান, আপনি হাত ধরে টেনে নেবেন লাইন পর লাইন।
কিন্তু আপনি যদি সত্যি বুঝতে চান—একটি নারীর শরীর কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিরোধে রূপ নেয়, একটি ছেলের প্রেম কীভাবে রাষ্ট্রবিরোধিতার ঝুঁকি নেয়,
তাহলে—এই বইটি আপনার জন্য।
এটি একটি রক্তাক্ত প্রেমের গল্প।
একটি যৌনতায় পবিত্রতার গল্প।
একটি গেরিলা যুদ্ধের গল্প, যেখানে ক্যামেরা আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়েও বেশি তীক্ষ্ণ।
ভালোবাসা কখনও শুধু ভালোবাসা নয়।
সেটা একেক সময় হয়ে ওঠে প্রশ্ন, প্রতিরোধ, কিংবা ইতিহাসের ওপর লেখা এক অনির্বাণ স্বাক্ষর।
এই বই সেই স্বাক্ষরের নাম।
– লেখক
রাঙামাটি।
মুন্না দাঁড়িয়ে ছিল লঞ্চঘাটে, চোখে কালো রেই-বেন সানগ্লাস, হাতে ধরা চামড়ার ফোল্ডার। বাইরের পরিচয় – কলেজ ছাত্র। ভেতরের পরিচয় – একজন অনুসন্ধানী কলমসৈনিক, বেসরকারি সংবাদ সংস্থার হয়ে কাজ করে, সরকারি নথি ঘেঁটে জানতে চায় পাহাড়ের গহীনে চলা এক রহস্যময় আন্দোলনের প্রকৃত রূপ। আজ সে যাচ্ছিল শান্তিবাহিনীর জঙ্গলে—ছদ্মবেশে, নিজের পরিচয় আড়াল করে।
সাথে জনি, তার সহপাঠী এবং ‘বন্ধু’। শান্ত, স্নিগ্ধ, গম্ভীর চেহারার এই জনি আসলে একজন ক্যাম্প কমান্ডার—’ক্যাপ্টেন বান্টি’। মুন্না জানে না সে কোন খেলায় ঢুকছে।
লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছিল সকাল ৮:৪৯-এ। দড়ি গুটিয়ে মন্টু নামের খালাসী জোরে হাঁক ছাড়ে। লঞ্চটা রিভার্স গিয়ারে চালিয়ে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হলো—সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশের ছায়ায়, নিঃশব্দে প্রবেশ করল এক অনির্ধারিত যাত্রায়।
মুন্নার চোখে দৃশ্যগুলো মোহ তৈরি করছিল না—তার চোখ ছিল অনুসন্ধানে। এই শান্ত, নীল জল আর সবুজ পাহাড়ের ছায়ার আড়ালে কি লুকিয়ে আছে?
লঞ্চে মালিকের ছেলে নিজাম নিজে এসে খাবারের ব্যবস্থা করে দিলো—শুঁটকি ভর্তা আর গরম ভাত। মুন্না খেয়েছে, কিন্তু মুখে রুচি নেই। তার মন পাহাড়ের পেছনে, সেই অদৃশ্য কেম্পে যেখানে গোপনে চলছে বিদ্রোহ।
জনি হঠাৎ বলল, “আজ রাতে মাশিদের বাড়িতে চল। অনেক কিছু শুনবি। জুম চাষ, ইতিহাস, যুদ্ধ, আর… আমাদের সত্যিকারের স্বপ্ন।”
মুন্না হেসে বলল, “আমার স্বপ্ন কিন্তু একটু ভিন্নরকমের… চে গেভারা পড়ে বড় হয়েছি। বিপ্লব মানে শুধু যুদ্ধ না, কিছু শরীরী উত্তাপও চাই।”
জনি তাকিয়ে রইল, একরাশ বিস্ময়ে। তারপর মুচকি হেসে বলল, “পাহাড়ের ভেতর অনেক রহস্য থাকে বন্ধু। শুধু বিপ্লব না… মোহ, মায়া, কামনা, নিষিদ্ধতা। সব আছে।”
লংগদু পৌঁছে নৌকায় উঠে পড়ল তারা। দেশি কাঠালতলি টাইপের নৌকা, সাথে দুই মাঝি। একজন মাঝি ছিল যুবতী। তার চোখে ছিল সেই রহস্য, যা শরীর ছুঁয়ে না গিয়েও কামনা জাগাতে পারে। মুন্না তাকাল। মাঝির ঠোঁটের কোণে এক প্রকার তাচ্ছিল্য, যেন পাহাড়ি নারী জানে, কারা তাদের শুধু “দেখে” যায়, আর কারা “অনুভব” করে।
ঘণ্টা দেড়েক পর তারা পৌঁছাল ক্যাম্পের পূর্ববর্তী পাহাড়ে। রাত তখন গভীর। ঘন জঙ্গল, চারদিকে পোকামাকড়ের জোনাকি আওয়াজ, জোছনার ছায়া, আর ক্লান্তি মেশানো রহস্যে মুন্নার শরীর ভারী হয়ে পড়ছিল। ঠিক তখনই দেখা সেই প্রথম—
লুম্বিনি।
সে শুধু পাহাড়ের মেয়ে না—সে যেন কার্বনের আগুন, হিমালয়ের মেঘ আর পদ্মফুলের নিষিদ্ধ গন্ধের সংমিশ্রণ। পাথরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল, হেরিকেন হাতে। চোখে ধরা পড়ে হঠাৎ চমক। মুখের গড়ন রাজবংশীয়, ঠোঁট যেন রক্তাক্ত কোনও কবিতা। জিন্স আর টপ পরা এই নারীকে দেখে মুহূর্তে ভুলে গেল মুন্না সে আসলে একটি তদন্তে এসেছে।
“আপনি প্রিয়তম?” লুম্বিনির কণ্ঠে মধুর শীতলতা, কিন্তু তীক্ষ্ণতা সেই বর্মি খঞ্জরের মতো।
মুন্না চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ, কে আপনি?”
“আমি লুম্বিনি। জনি দা আমাকে আপনাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনি ক্লান্ত। আসুন।”
বিছানায় পড়ে থাকা মুন্নার সারা শরীর যেন এক লোমশ উত্তেজনায় সাড়া দিল। সে অনুভব করল, এই মিশন কেবল গুপ্তচরবৃত্তির না—এটা এক নিষিদ্ধ কামনার অধ্যায়। যে পাহাড়ে অস্ত্র মজুত, সেই পাহাড়েই লুকিয়ে আছে প্রেম, লিপ্সা আর প্রতিশোধ।
রাত গভীর হলো। পাহাড়ের এক চূড়ায় তারা দু’জন। পাহাড়ি বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর জলপ্রপাতের শব্দের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল লুম্বিনি। মুন্না এগিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য লুম্বিনির চোখ পড়ল তার চোখে। একটা থেমে থাকা নিঃশ্বাস, তারপর হঠাৎই তারা একে অপরের ঠোঁটে, গন্ধে, স্পর্শে, নিঃশব্দ হিংস্রতায় হারিয়ে গেল…
অধ্যায়ঃ ২ লুম্বিনির রাত্রি
(গুপ্তচর, কামনা, আর আগুনে ভেজা পাহাড়ি রাত্রি)
আধো আলো আধো অন্ধকারে কাঠের ঘরের দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। লালচে আলোয় জ্বলে থাকা হারিকেনের কাচে তার ছায়া কাঁপছিল। হঠাৎ মনে হলো—এই ছায়া যেন কোনো মানবীর নয়, যেন জ্বলন্ত শালুকফুলের ছায়া।
“আপনি ঘুমিয়েছিলেন,” তার কণ্ঠস্বর, ভাঙা হিন্দি-ছোঁয়া বাংলায়, এক মাদকতা এনে দিল মুন্নার সারা শরীরে।
মুন্না কাত হয়ে উঠে বসে। বিছানার চাদরে এখনো তার শরীরের ঘামের গন্ধ। ক্লান্তি আর উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দন বাড়ছিল।
“ভাত খেতে হবে। জনি দা বলেছে আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য।”
লুম্বিনি এসে দাঁড়াল, খুব কাছেই।
তার পরনে একটা হালকা সবুজ লং স্কার্ট আর সাদা পাতলা জামা, ভেজা চুল থেকে অদ্ভুত এক গন্ধ আসছিল—বৃষ্টিভেজা কাঠ আর লেবুপাতার মতো।
খাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। পাটপাতায় সাজানো ছিল ভাত, পাহাড়ি মাংস, আর একটা সুগন্ধি ভর্তা। মুন্না খেতে খেতে দেখছিল লুম্বিনির চোখ—বড়ো, গভীর, আর অদ্ভুত রকম চুপচাপ।
খাওয়ার পর লুম্বিনি বলল, “চলেন একটু নিচে যাই, ছড়ার ধারে।”
পাহাড়ি ঘাটে তারা বসে। দূরে ঝরনার শব্দ, গাছে গাছে আলো-ছায়ার খেলা, আর তাদের মাঝখানে এক অদ্ভুত, বিদ্যুতের মতো থরথর ভাব।
“তোমার চোখে আমি কী?” মুন্না জিজ্ঞেস করে।
লুম্বিনি তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ—তারপর বলল, “একটা অদ্ভুত পুরুষ। ভিতরে ভিতরে ফাটা কাচের মতো। যার ছোঁয়ায় কেটে যেতে পারে কেউ, আবার আলোও প্রতিফলিত হয়।”
মুন্না হেসে বলল, “তুমি কবিতা লেখো নাকি গুলি চালাও?”
সে একধরনের অন্ধকার হাসি হেসে বলল, “দুটোই পারি। কিন্তু আজ আমি শুধু নারী।”
হঠাৎ লুম্বিনি তার দিকে ঘুরে মুখ রাখল মুন্নার কাঁধে। তার দম নরম, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে ছিল আগুন। মুন্না নিঃশব্দে ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “তুমি জানো, আমি কে?”
“জানি না,” সে বলল, “জানতে চাইও না। আজ রাতে শুধু শরীর চেনে শরীর, মন চেনে মন। কাল যদি তুমি বিশ্বাসঘাতক হও—তাও আজ রাতে আমি শুধু তোমার।”
তারপর সময় থেমে গেল। জঙ্গলের মাঝখানে, ঝরনার শব্দে ঢাকা পড়ে, তাদের দুজনের শরীর একে অপরকে খুঁজে নিল। স্পর্শে শত্রুতা ভেঙে পড়ল, আত্মরক্ষার ভান খুলে গেল। সেই রাত যেন কোনো ইতিহাসের নয়, কোনো নৈতিকতার নয়—শুধুই দেহ, রক্ত, কামনা আর নিঃস্বর্ত ভালোবাসা।
মুন্না জানত, এই মুহূর্তটাই তার শেষ হতে পারে। কেউ যদি দেখে ফেলে, কেউ যদি সন্দেহ করে…
কিন্তু সে-রাতে, চাঁদটা পাহাড়ের আড়ালে ছিল, আর তারা দুজন ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন এক নিঃশব্দ চুক্তির মাঝে।
অধ্যায় ৩ঃ ক্যাম্পের অন্তরালে
সকালের আলো ফোটার আগেই মুন্নার ঘুম ভাঙে। লুম্বিনি তখনও পাশেই, নিঃশ্বাসে তার দেহে রাতের ঘাম আর চন্দনগন্ধের ছাপ। পাহাড়ি বাতাসে সজীব হয়ে ওঠা শরীর, কিন্তু মনে শুরু হয়েছে দোটানা—সে একজন গুপ্তচর, অথচ এই কেম্পে যেন সে হয়ে উঠছে অন্য এক মানুষ।
কাঠের দরজায় ঠকঠক শব্দ। বাইরে থেকে লুম্বিনির কণ্ঠ – “চলো, আজ তোমাকে কিছু দেখাবো।”
দুজন বেরিয়ে পড়ল কেম্পের ভেতরে। রোদ তখনও জঙ্গলের ঘন সবুজ ছায়া ছুঁয়ে নামেনি, কিন্তু ক্যাম্প জেগে উঠেছে। দূরে ছোট এক টেবিল-সমান উঁচু পাহাড়ি সমতলে চলছিল অস্ত্র প্রশিক্ষণ। ১৫-১৮ বছরের মেয়ে, পুরুষ, এমনকি কিশোরদের হাতে AK-47, চাইনিজ রাইফেল আর ম্যাগাজিন ভর্তি ব্যাগ।
মুন্নার চোখ কেঁপে ওঠে। যুদ্ধ সে দেখেছে গল্পে, কিন্তু এভাবে, এত সুশৃঙ্খল গেরিলা ট্রেনিং সে কল্পনাও করেনি।
লুম্বিনি তার কানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি ভেবেছিলে আমরা শুধু বেহালার সুরে বিপ্লব করি?”
ক্যাম্পের ভেতরে ছোট ছোট টিনের ঘর, জঙ্গলের কাঠ দিয়ে বানানো স্টোর, রান্নাঘর, ওষুধের ঘর এবং একটি সেমি-আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টার। শেল্টার ঘরটির দরজায় পাহারা দিচ্ছে দুই অস্ত্রধারী নারী যোদ্ধা। ওদের চোখে আগুন, ঠোঁটে গর্ব।
“ওটা অস্ত্রাগার,” লুম্বিনি বলে, “শুধু নিজেরা চালায় না, বাইরে বিক্রি করে। মিজোরাম, নাগা, এমনকি বর্ডার পেরিয়ে যায় কিছু চালান। তোমার ধারণা ছিল?”
মুন্না মাথা নেড়ে না বলে। মনে মনে ফিসফিস করে, “আমি যা দেখছি তা কোনো রিপোর্টে লেখা যাবে না। এ এক বিপ্লবের যৌনতম রূপ… যেখানে দেহ, রাজনীতি আর অস্ত্র একই মঞ্চে।”
হঠাৎ তার চোখ পড়ে জনির দিকে—না, আজ সে আর কলেজবন্ধু জনি নয়। সে এখন ক্যাপ্টেন বান্টি। তার চারপাশে ৫-৬ জন নারী কেডার, ব্রিফিং নিচ্ছে গোপন এক অভিযানের। মুন্নাকে দেখে শুধু চোখ তুলে মৃদু হাসি দিলো, কিন্তু কিছু বললো না। যেন সে-ও জানে—এই অতিথি এক অচেনা ভাষায় কথা বলে।
মুন্নার মনে তখন একটাই চিন্তা: “আমি শুধু দেখতে আসিনি। জানতে এসেছি। কিন্তু এই আগুনের কাছে কতটা নিরাপদ আমি?”
ক্যাম্পের মাঝখানে তখন বাজছে পাহাড়ি বাঁশির মেলোডি। হঠাৎ সবাই থেমে গেল। এক নারী যোদ্ধা সামনে এসে দাঁড়াল। তার গলায় ছিল খয়েরি গামছা, হাতে লাল কাপড়ে মোড়া কিছু নথি।
“এই ফাইলে আছে সামনের অভিযানের পরিকল্পনা। আজ রাতে ছয়জন পাড়ি দেবে কর্ণফুলীর উজানে। অপারেশন: ‘সন্ধ্যার আগুন’। কেউ কথা বলবে না। যার বিশ্বাস নেই, এখনই চলে যাও।”
লুম্বিনি পাশ ফিরে তাকালো মুন্নার দিকে। তার চোখে প্রশ্ন – “তুমি কি এই বিপ্লবের দর্শক, নাকি অংশীদার?”
মুন্না চুপ। কারণ তার উত্তর এখনো লেখা হয়নি…
অধ্যায় ৪: বিশ্বাসের চোরাস্রোত
সন্ধ্যার আগুন নামের অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুরো ক্যাম্প। কিন্তু মুন্নার মনে এখন আর কেবল অনুসন্ধান নয়, ঢুকে পড়েছে দ্বন্দ্ব—এই বিপ্লবের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা মানবিক অনুভব, অনৈতিক লেনদেন, আর বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভাবনা।
লুম্বিনি যেন আজ একটু অচেনা। তার চোখে দেখা যায় একধরনের দ্বিধা। সে মুন্নাকে বলল, “রাত নামলেই অনেক কিছু পাল্টে যায় এই পাহাড়ে। কারা বন্ধু, কারা শত্রু—বলা যায় না।”
মুন্না জবাবে বলল, “তোমার কাছে আমি কে, লুম্বিনি?”
লুম্বিনি চুপ করে রইল। মুখ ঘুরিয়ে বলল, “তুমি হয়তো আমার বিশ্বাস ভেঙে দেবে একদিন। কিন্তু এই মুহূর্তে… আমি শুধু চাই তুমি বেঁচে থাকো।”
রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পের উত্তর প্রান্তে ছয়জন কেডার তৈরি হচ্ছে। বান্টি নিজে উপস্থিত, হাতে কমপাস, ম্যাপ, আর একটি আধুনিক রেডিও সেট। পরিকল্পনা চলছে কিসের? মুন্না জানে না। কেবল আঁচ করতে পারে—এই মিশনের পেছনে কোনো উচ্চমার্গের রাজনৈতিক চাল আছে।
তাদের চলার পথে দেখা গেল দুই নতুন মুখ—একজন শহুরে ধরনের যুবক, চোখে সানগ্লাস, আরেকজন কাঁধে রাইফেল। মুন্নার দিকে তারা একটু বেশিই নজর দিয়ে তাকাল।
ক্যাম্পের ভেতরে ফিরেই লুম্বিনি বলল, “তাদের একজন তোমাকে সন্দেহ করছে। তুমি সাবধান থাকো।”
মুন্নার মনে পড়ে গেল, তার চামড়ার নোটবুকে আজকের ভেতরের বিবরণ লেখা আছে। যদি কেউ সেটা পায়, তবে…
সে দ্রুত ফিরে গেল ঘরে। পেছনে পায়ের ধুপধাপ শব্দ। দরজা বন্ধ করতে না করতেই কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “প্রিয়তম ভাই, আপনি ঘুমাননি বুঝি?”
মুন্না কাঁপা গলায় বলল, “না, একটু মাথা ধরেছে।”
কণ্ঠস্বর বলল, “ক্যাপ্টেন বান্টি আপনাকে ডেকেছেন।”
ঘড়ি দেখে মুন্নার মনে হলো—এই সময় কেউ কাউকে ডাকে না, যদি না তা হয় জরুরি।
ক্যাম্পের পেছনের ছোট ঘরে বান্টি দাঁড়িয়ে। তার মুখ থমথমে। হাতে নোটবুকটা।
“এটা তোমার?”
মুন্নার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। সে জানে, এটাই শেষ মুহূর্ত হতে পারে। অথচ বান্টি শুধু তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, “আমাদের অনেক কিছুই ভুল হতে পারে, মুন্না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা নয়। আমি তোমাকে এখনো বিশ্বাস করি। কারণ লুম্বিনি তোমাকে বিশ্বাস করে।”
মুন্নার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
“তুমি যা জানো, তা লিখে রেখো। কিন্তু এখনই ছড়িয়ো না। সময় হলে, হয়তো তুমিই লিখবে ইতিহাস। কিন্তু এখন শুধু দেখে যাও। যতোক্ষণ বিশ্বাস রাখো আমাদের মধ্যে।”
লুম্বিনি দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। মুখটা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “তুমি এখান থেকে গেলে আমি আবার অন্ধকার হবো, মুন্না। বিশ্বাস করো, আমি এই আগুনের মধ্যে থেকেও একটু শান্তি চেয়েছিলাম, তোমার সাথে।”
মুন্না বুঝে গেল—এই পাহাড় কেবল রক্ত আর বন্দুকের ঠিকানা নয়। এটা প্রেম, প্রতারণা আর মানুষ হয়ে থাকার শেষ যুদ্ধের মঞ্চ।
অধ্যায় ৫: রক্ত, নদী আর পালিয়ে যাওয়া
রাত তখন গভীর। পাহাড়ের গায়ে চাঁদের আলো পড়ে তৈরি করেছে সাদা ছায়া। ক্যাম্পে আচমকা হইচই। বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ ভেসে এলো পূর্ব দিক থেকে—ঝরনার পাশে রাখা গোলাবারুদের একটি গুদাম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
এক মুহূর্তে ক্যাম্প রেড অ্যালার্ট। ক্যাডাররা ছুটছে, অস্ত্র হাতে নিচ্ছে, কেউ কেউ পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। শিস বাজিয়ে সংকেত দেওয়া হলো—‘অভ্যন্তরীণ হামলা’ বা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’।
মুন্না তখনো ঘরেই। দরজা খুলতেই বান্টি ঢুকে পড়ল, হাতে রাইফেল। চোখে খিচ ধরা সন্দেহ, তীব্র রাগ নয়, বরং একটা নীরব ধৈর্য।
“কেউ আমাদের ভেতর থেকে লোক পাঠিয়েছে। রেডিওতে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে একবার। ক্যাম্পের কো-অর্ডিনেটস ফাঁস হয়েছে।”
মুন্না বলল না কিছু। শুধু কাঁপা হাতে নিজের নোটবুকটা বান্টির দিকে এগিয়ে দিল। “তুমি যদি চাও, আমি এখানেই থেকে যাবো না।”
বান্টি একটু নড়ল না। বলল, “আমি চাই তুমি লুম্বিনিকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাও। এখনই। আমরা বাকি দায়িত্ব সামলাব।”
“তুমি বিশ্বাস করো আমাকে?”
“না,” বান্টি কাঁপা গলায় বলল, “আমি বিশ্বাস করি লুম্বিনিকে।”
লুম্বিনি তখন ছুটে এলো, ব্যাকপ্যাক হাতে, চোখে জল আর আগুনের মিশ্র ভাষা। “চলো মুন্না, এখানে তোমার থাকা ঠিক না।”
তারা পাহাড়ি চোরাপথে নামতে লাগল। নিচে নদীর শব্দ—প্রচণ্ড জোরে বইছে কর্ণফুলী। দুজন দৌড়ে যাচ্ছে, পিছনে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বন্দুকের গুলি, চিৎকার, আর কে যেন শিস বাজিয়ে বারবার সংকেত দিচ্ছে।
ঝিরিপথ বেয়ে হঠাৎ গড়িয়ে পড়ে গেল লুম্বিনি। হাঁটু ছিঁড়ে গেছে। মুন্না তার রক্তাক্ত পা কোলে তুলে নিয়ে বলল, “তুমি যদি না পারো হাঁটতে, আমি তোমাকে বহন করব।”
লুম্বিনি জোর করে দাঁড়ালো, দম নিল। তারপর বলল, “তুমি জানো মুন্না, তুমি যদি চেয়ো, আমি সেই প্রথম রাতে তোমাকে মেরে ফেলতে পারতাম। আমার পিঠে সবসময় একটা ছোট ছুরি থাকে।”
মুন্না স্তব্ধ। “তুমি মারো নি কেন?”
লুম্বিনি মুখ তুলে তাকাল, “কারণ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ভালোবাসা কি অস্ত্রের চেয়েও বড়ো হতে পারে?”
নদীর কিনারায় তারা পৌঁছে গেল। লুম্বিনি কোমরে বাধা ছোট রেড ফ্ল্যাশলাইট বার করে একবার জ্বালিয়ে নিভিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর ঝোপের ভেতর থেকে এক মাঝি কণ্ঠস্বর দিল, “তিনজনের জায়গা আছে, দেরি কোরো না।”
“তুমি যাবে তো?” মুন্না জিজ্ঞেস করল।
“তুমি চাও?” লুম্বিনির প্রশ্নে ছিল খালি নয়, খাঁটি চাহনি।
মুন্না এগিয়ে এসে তার হাতে হাত রাখল। “আমি শুধু চাই, তুমি আর আমি—এই রক্ত, এই নদী আর আগুনের বাইরে একটা নতুন গল্প লিখি।”
তারা নৌকায় উঠল। পেছনে ক্যাম্পে আবার গুলির আওয়াজ, আর আগুনের ধোঁয়া উঠে চলেছে আকাশে।
নৌকা বেয়ে সামনে এগিয়ে চলল তারা, অজানার দিকে।
অধ্যায় ৬: পলায়নের রাতে, দেহের বিপ্লব
নৌকা ছুটে চলেছে কর্ণফুলীর ঢেউয়ের বুক চিরে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝির বৈঠার ছলছল শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার রাতের গান।
নদীর পাড়ে উঠে আসতেই তারা ঢুকে পড়ে এক নির্জন বাঁশবনের ভিতর। এখানে কোনো আলো নেই, কেবল চাঁদের টুকরো আলো গাছের পাতায় পড়ে তৈরি করছে ছায়ার নকশা।
মুন্না আর লুম্বিনি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ায় এক ঝরনার ধারে। সেখানেই তারা পড়ে বসে। বাতাসে ভিজে পাতা, কাদামাটি আর পাহাড়ি ফুলের গন্ধ। মুহূর্তটা যেন বাস্তব নয়, স্বপ্নের মতো।
হঠাৎ লুম্বিনি কাছে এসে দাঁড়ায়। তার চুল ভেজা, চোখে অদ্ভুত জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে মুন্নার দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে তার গায়ের ওড়নাটা খুলে ফেলে।
সে যেন জিজ্ঞেস করল না—বলেই দিল, “আজ রাতে তুমি আমার শরীরের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হও।”
মুন্না চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর হঠাৎ যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দিকে। এক মুহূর্তে ঠোঁট খুঁজে নেয় ঠোঁট, আঙুল খুঁজে নেয় চুল, গলা, পিঠ, নিতম্ব।
লুম্বিনির দেহ পাহাড়ি নদীর মতো—একবারে হিম, একবারে আগুন। তার গায়ের রং গাঢ় মাটি আর লাল সূর্যাস্তের মিশ্রণ, যেন ধূপ-ধূয়ার শরীর। তার স্তন দুটো ছিল শক্ত, পাকা আনারসের মতো, আর তার কোমর—পাতলা ও বাঁকানো ঠিক তীরের মতো, যা যেকোনো পুরুষের আত্মাকে বিদ্ধ করতে পারে।
মুন্না, যেন এক বুনো ঘোড়া—তৃষ্ণার্ত, বন্য, অধৈর্য। তার ঠোঁট, তার জিভ, তার আঙুল যেন একসঙ্গে ছুঁয়ে ফেলছিল লুম্বিনির আত্মা। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে সে লুম্বিনিকে বশ করছিল এক আদিম খেলার মতো—যেখানে শরীর ভাষা হারায়, আর ভাষা হয়ে ওঠে নিঃশ্বাস।
তারা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চারদিকের ছায়া যেন গান গাইতে লাগল, বাতাস থেমে গিয়ে দেখছিল তাদের। গন্ধরাজের ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছিল, আর কর্ণফুলীর স্রোত বহন করে নিচ্ছিল কামনার স্পর্শ।
সে রাতে পাহাড় সাক্ষী ছিল—দুই প্রেমিক, এক বিপ্লব, আর শরীরের বিপ্লব। লুম্বিনির মুখে তখন কেবল একটাই শব্দ—“মুন্না… তুমি আমার বিপ্লব, তুমি আমার শান্তি।”
তারা ঘুমিয়ে পড়ল নগ্ন শরীরে, একে অপরের বাহুতে জড়িয়ে। চারদিক ছিল ঠান্ডা, কিন্তু তাদের ভেতর ছিল আগুন। আর সেই আগুন নিভল না, যতক্ষণ না রাত শেষ হলো।
অধ্যায় ৯: নারীর নাম বিপ্লব
তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর, লুম্বিনি ফিরে এল না আগের ক্যাম্পে, না মুন্নার কাছে। সে আশ্রয় নেয় পাহাড়ের আরেক পাশে—পুরনো এক পাথরের গুহা যেখানে কিছু নারী কেডার গা ঢাকা দিয়ে ছিল। এদের অনেকেই ক্যাম্পের পুরনো যোদ্ধা—কিন্তু নতুন চুক্তি, নতুন নেতার কাছে তারা ‘বোঝা’ হয়ে উঠেছে।
“তোমরা চাও?” লুম্বিনি গর্জে উঠল, “এই পাহাড় হোক শুধু পুরুষদের দখলে?”
কেউ মাথা নিচু করল না। চোখে চোখ রাখল। তারপর একে একে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
এই প্রথম, লুম্বিনি নিজের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করল নতুনভাবে। সে শুধু কারো প্রেমিকা নয়, কারো শরীরের খেলার পুতুল নয়। সে নিজেই এক বিপ্লব, এক বিপ্লবী নারী, যাকে থামাতে পারবে না বন্দুক, না বিশ্বাসঘাতকতা।
তারা শুরু করল এক নতুন মিশন—’অগ্নিকন্যা’ নামে। নতুন ট্রেনিং, নতুন কোড, নতুন অস্ত্র। রাতে তারা পাহাড়ি গ্রামে ঘুরে ঘুরে খোঁজে সেইসব নারী যারা হারিয়েছে সন্তান, সম্মান কিংবা স্বামী—তাদের একত্র করে।
এক রাতে, পাহাড়ি কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ ভেসে আসে একটি চেনা কণ্ঠ:
“তুমি সত্যিই বদলে গেছো, লুম্বিনি।”
সে ঘুরে দেখে—মুন্না। চোখে ক্লান্তি, মুখে দাড়ি, হাতে ক্যামেরা।
“তুমি?” লুম্বিনির গলা কেঁপে ওঠে।
“আমি ফিরে এসেছি। কারণ আমি দেখেছি তুমি শুধু এক নারী নও, তুমি এক বিপ্লবের নাম।”
লুম্বিনি তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে বলে, “আমি এখন কাউকে ভালোবাসতে পারি, কিন্তু তার ছায়া হয়ে থাকতে পারি না।”
মুন্না হাসে, চোখে অভিভূত সম্মান। “তাহলে চলো পাশে থাকি—ভালোবাসার নয়, বিপ্লবের পাশে।”
এভাবেই জঙ্গলের গভীরে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—যেখানে প্রেম আর যুদ্ধ একসঙ্গে বুনে চলে আগুনের চাদর, নারীর নামে লেখা এক বিপ্লবের ইতিহাস।
অধ্যায় ১০: আগুনে ফেরা, অগ্নিকন্যার প্রথম আঘাত
রাত গভীর। চাঁদের আলো জঙ্গলের মাটি ছুঁয়ে পড়ছে থমকে থাকা নিস্তব্ধতার উপর। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল এক গর্জনে। ‘অগ্নিকন্যা’ দল প্রথমবারের মতো আঘাত হানল অভিজিৎ-এর শহুরে সেনাঘাঁটির ওপর।
বাইরে থেকে যে ক্যাম্প দেখায় শান্তিপূর্ণ NGO-এর কেন্দ্র, ভিতরে তা অস্ত্র, লেনদেন আর স্বার্থের আখড়া।
লুম্বিনি নেতৃত্বে—চোখে কালো লাইনার, মাথায় বাঁধা স্কার্ফ, হাতে নতুন কাস্টম রাইফেল। পাশে মুন্না, যোদ্ধা না হলেও তার ক্যামেরা বন্দি করছে বিপ্লবের প্রতিটি স্পন্দন।
“শুধু গুলি নয়,” লুম্বিনি বলেছিল আগের রাতে, “আমাদের অস্ত্র হবে বার্তা। ওদের ভয় দেখানো নয়, মুখোশ খুলে দেওয়া।”
তারা একে একে ঢুকে পড়ে ক্যাম্পে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, সাইরেন বাজে না। ঘরে ঘরে পোস্টার লাগানো হয়—“এই পাহাড় বিক্রি হয় না”, “নারী দখল নয়, নেতৃত্ব চায়”।
কিন্তু সবার শেষে, অভিজিৎ-এর রুমে ঢুকে পড়ে লুম্বিনি একাই। অভিজিৎ তখনো জেগে। হাত বাড়ায় পুরনো ভঙ্গিতে, “তুমি তো জানো, তুমি একা কিছু করতে পারবে না।”
লুম্বিনি তার দিকে তাকায়—“তুমি ভুল বুঝেছিলে, আমি কখনো একা ছিলাম না। আমি ছিলাম অপেক্ষায়।”
এক মুহূর্তের ঝাঁপ। অভিজিৎ ঘায়েল হয় না গুলিতে, বরং লুম্বিনির হাতে বানানো পার্সোনালাইজড পেরালাইজার ডার্টে।
“এটা মৃত্যু নয়,” লুম্বিনি বলে, “এটা লজ্জা, যে তুমি আর কারো সামনে দাঁড়াতে পারবে না।”
তারা ক্যাম্প ছাড়ে ভোরের আগে। মুন্নার ক্যামেরায় বন্দি হয় নারীদের বিজয়, কোনো রক্ত ছাড়াই।
এ ছিল ‘অগ্নিকন্যা’র প্রথম আঘাত—নিঃশব্দ, নির্ভুল, এবং নারী নেতৃত্বে পাহাড় পুনর্দখলের শুরু।
অধ্যায় ১২: ক্যামেরার চোখে বিপ্লব
আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। অগ্নিকন্যা ক্যাম্পে আজ অদ্ভুত নীরবতা।
লুম্বিনি মুন্নার দেওয়া ক্যামেরাটি অনেকক্ষণ ধরে ধরে রেখে বসেছিল। তার মনের ভেতরে তখন ঝড়—পালিয়ে গেল? নাকি বুঝে উঠতে পারেনি ভালোবাসা মানে কী?
কিন্তু ক্যামেরার শেষ রেকর্ডিং চালু করতেই থমকে গেল সে।
“তুমি জানো, লুম্বিনি,” ভিডিওতে মুন্নার কণ্ঠ ধরা আছে, “তুমি যা করছো তা ইতিহাসের পাতায় লেখা হওয়া উচিত, কারও প্রেমিক হতে নয়, কারও শরীরের জ্যামিতিতে বাঁধা নয়।”
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—অস্ত্র হাতে মেয়েরা পাহাড়ে ওঠানামা করছে। রক্তমাখা ব্যান্ডেজে যুদ্ধরত কিশোরীরা। ক্যাম্পের রান্নাঘরের মহিলারা অস্ত্র মেরামত করছে। এই সব দৃশ্য মুন্নার চোখে বন্দি।
আরেকটি দৃশ্যে ক্যামেরার লেন্স ধীরে ধীরে ঘুরে এসেছে লুম্বিনির দিকে।
সে হাসছে, সে তর্ক করছে, সে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে শুধু একজন প্রেমিকা নয়। একজন বিপ্লবী। একজন আগুনকন্যা।
শেষে একটি নোট—মুন্নার কণ্ঠে:
“আমি জানি, তুমি হয়তো ভাববে আমি তোমায় ছেড়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি যদি থেকে যেতাম, আমি হয়তো তোমার পথের রঙ বদলে দিতাম। তুমি আকাশ—তোমার দরকার মুক্তি। আমার নয়।”
লুম্বিনি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল।
তার চোখে জল নেই। কারণ সে জানে, মুন্না প্রেম দিয়ে নয়, চেতনা দিয়ে তাকে ছুঁয়েছিল।
সে ক্যামেরার লেন্সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলল—
“তুমি ঠিক বলেছিলে, মুন্না। আমি কারও প্রেমিকা না। আমি ইতিহাস।”
অধ্যায় ১৩: সীমান্তের ওপারে, কূটনীতির খেলা
লুম্বিনি বুঝেছিল, সময় এসেছে পাহাড়ের এই প্রতিবাদকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার। অগ্নিকন্যাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে—সংঘর্ষ নয়, অস্তিত্বের লড়াই।
সে একটি ছোট দল নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ঢোকে ভারতীয় মিজোরামে। পাহাড়ি এক পুরনো চার্চে আশ্রয় নেয়, যেখানে এখন কাজ করছে ইউরোপীয়ান স্বেচ্ছাসেবকরা। সেখানেই পরিচয় হয় ফাদার ডমিনিকের সাথে—একজন শান্তিকর্মী ও জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধি।
লুম্বিনি তাদের সামনে তুলে ধরে মুন্নার ক্যামেরায় তোলা ফুটেজ, ক্যাম্পের নারীদের সংগ্রাম, শহুরে দখলদারদের ষড়যন্ত্র এবং স্থানীয়দের বঞ্চনার প্রমাণ।
ফাদার ডমিনিক চুপচাপ দেখে যান সব। শেষে বলেন, “তোমার বিপ্লব বন্দুক নয়, বার্তার মাধ্যমে টিকবে। আমরা চেষ্টা করবো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়ে সচেতনতা গড়তে। তবে সাবধান, তোমার শত্রুরা শুধু পাহাড়ে নয়, নরম আলোতেও আছে।”
এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্রাসেলসের এক হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে উঠে আসে ‘Agni Kannya Movement in Chittagong Hill Tracts’। লুম্বিনির ছবি ছাপা হয়—চোখে আগুন, হাতে পতাকা।
এদিকে অভিজিৎ বুঝতে পারে, বিপদ আসছে বাইরে থেকে—নতুনভাবে। আর সে প্রতিশোধের ছক আঁকতে শুরু করে। কিন্তু এইবার যুদ্ধ শুধু আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হবে না, হবে মিডিয়া, মিথ্যা, মনস্তত্ত্ব আর বিশ্বাসঘাতকতার ঘূর্ণাবর্তে।
অধ্যায় ১৪: পূর্বের ছায়া, বার্মিজ আগ্রাসন
রাতের পাহাড় অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল। অগ্নিকন্যা ক্যাম্পে সবাই ব্যস্ত ছিল আন্তর্জাতিক সমর্থনের খবরে—কেউ রিপোর্ট পড়ছে, কেউ প্রস্তুত করছে পরবর্তী দাওয়াত-নথি। কিন্তু ঠিক তখনই, রাত ২টা ৪৭ মিনিটে, হঠাৎ শোনা গেল এক বিস্ফোরণ। তারপর গুলির শব্দ।
লুম্বিনি জানত, এটা কোনো স্থানীয় দস্যু বা দখলদার নয়। এটা পরিকল্পিত, প্রশিক্ষিত এক হামলা।
ক্যাম্পের পাহাড়ি প্রহরীরা দ্রুত বার্তা দিল—“ওরা বার্মিজ! আর ওদের সঙ্গে আছে সেই ১৯৭১-এর পরাজিত পাক বাহিনীর কয়েকজন পালিয়ে যাওয়া ঘাতক।”
লুম্বিনির শরীর জমে গেল। যেসব দানব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মুছে যাওয়া কথা ছিল, আজ তারা ফিরে এসেছে বার্মিজ সীমান্ত পেরিয়ে—নতুন অস্ত্র, নতুন ফান্ডিং আর পুরনো হিংসা নিয়ে।
এই হামলাকারীরা ছিল দুর্ধর্ষ। হাই-অল্টিচিউড নাইন ভিশন, পোর্টেবল মর্টার, রুশ এবং চায়নিজ হাইব্রিড অস্ত্র আর সর্বোপরি পেশাদার হানাদার মনোভাব।
অগ্নিকন্যারা প্রতিরোধ করছিল সাহসে, কিন্তু প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে তারা পিছিয়ে। গুলির শব্দে কেঁপে উঠছিল চারদিকের পাহাড়।
মুন্না তখন দূরে এক জঙ্গল ঘেঁষা নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিল। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল বাবার মুখে শোনা ১৯৭১-এর রাতগুলোর কথা—“জীবন বাঁচাও আগে, যুদ্ধ করো পরে।”
সে ব্যাগ থেকে বের করল একটি পুরনো পত্রিকা। সেখানে লিখে রেখেছিল এক সারভাইভাল ম্যাপ—যেটা একবার তার বাবা কাঁটাচামচ দিয়ে কেটেছিলেন এক ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে দেখে।
লুম্বিনি তখন ক্যাম্পের মেয়েদের নিয়ে ধাপে ধাপে পিছিয়ে যাচ্ছিল। তার হাতে রেডিও—“সাবধান, দক্ষিণ-পূর্ব বোট ঘাটেও অ্যামবুশ থাকতে পারে।”
এক কিশোরী যোদ্ধা চিৎকার করে উঠল, “দিদি, ওরা আমাদের নাম ধরে ডাকে! ওরা তো আমাদের সাবেক ট্রেইনারদের নাম জানে!”
লুম্বিনির চোখে তখন জ্বলছিল রক্ত আর অভিমান। যে পিশাচরা তাদের শিখিয়েছিল ‘স্বাধীনতা মানে অস্ত্র’, তারাই আজ আবার এসেছে সেই অস্ত্র উল্টিয়ে দিতে।
শেষরক্ষা হয় এক বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি ছড়ার কিনারে। মুন্না তখন দিক নির্দেশনা দিচ্ছিল ছায়ায় থেকে—“ওই বাঁশবনের ভেতর লুকাও, তারপর ছড়ার ধারে স্লিপার ট্রেল আছে, যেটা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় অব্যবহৃত ছিল।”
তারা পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু অগ্নিকন্যার প্রথম ঘাঁটি—পুড়ে ছাই। লুম্বিনির চোখে তখন জল নয়, আগুন। তার কণ্ঠে একটাই শব্দ:
“এটা যুদ্ধ নয়, এটা ইতিহাসের প্রতিশোধ।”
অধ্যায় ১৫: জঙ্গলের গহীনে, আগুনের নতুন আঁচল
পাহাড়ি ছড়ার কিনারা ধরে তিন রাত আর চার দিন হেঁটে পৌঁছায় তারা—একদম ভেতরের দিকে, যেখানে না আছে পথ, না আছে নকশা।
লুম্বিনি বলেছিল, “আমরা আগুন থেকে এসেছি। এখন আমাদের ছায়ার নিচে আগুন তৈরি করতে হবে।”
জায়গাটা ছিল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উঁচুতে, এক অরণ্য ঘেরা উপত্যকা, যেখানে দিনের আলো পৌঁছাতে দেরি হয়, আর রাত নামে নিঃশব্দে। এখানেই শুরু হয় ‘অগ্নিকন্যা পুনর্জন্ম’—নতুন ঘাঁটি, নতুন গোপন সংকেত, এবং নতুন কৌশল।
এবার আর শুধু যুদ্ধ নয়, এবার হবে গেরিলা নেটওয়ার্কিং। স্থানীয় কিছু উপজাতীয় পরিবার, যাদের ভূমি দখল হয়ে গিয়েছিল বার্মিজ আগ্রাসনে, তারাও এসে যোগ দেয় এই অগ্নিসংগ্রামে।
মুন্না পাহাড়ি পাথরের গায়ে আঁকতে শুরু করে ‘Survival Mapping’—১৯৭১ সালের বাবার ডায়েরি থেকে নেওয়া সংকেত চিহ্ন, লুকানো খাদ্য মজুদের জায়গা, গোপন করিডর আর সংকেত পাথরের ছায়ায় লুকানো গুহার ম্যাপ।
একটি গাছের গায়ে খোদাই করে সে লিখে রাখে—“যদি ফিরে না আসি, আগুনটা নিভিও না।”
লুম্বিনি প্রতিটি মেয়েকে দিয়ে শপথ করায়, “আমরা অস্ত্র তুলবো, কিন্তু প্রতিটি গুলির আগে প্রশ্ন করবো—কার জন্য?”
নতুন ক্যাম্পের নাম রাখা হয় ‘চন্দ্রপাহাড় ঘাঁটি’। পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করা হয় একটি পুরনো তামার ঘন্টা—যেটা কেবল তখনই বাজবে যখন তারা নতুন অভিযান শুরু করবে।
মাঝেমধ্যেই, জঙ্গলের গভীর থেকে শোনা যায় বার্মিজ প্যাট্রোলের আওয়াজ, কিন্তু কেউ পৌঁছাতে পারে না চন্দ্রপাহাড়ে। কারণ লুম্বিনি এবং তার মেয়েরা এখন শুধু বিপ্লবী নয়, তারা পাহাড়ের আত্মা হয়ে উঠেছে—দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অনুভবযোগ্য।
আর দূরে, পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে মুন্না। ক্যামেরা কাঁধে, চোখে আগুনের আলো। সে জানে, তার ভূমিকা যুদ্ধ নয়। তার কাজ ইতিহাসকে ঠিকভাবে ধরে রাখা।
অধ্যায় ১৬: রক্তে লেখা প্রতিশোধ
ভোর ৪টা ৩৫ মিনিট। চন্দ্রপাহাড় ঘাঁটির তামার ঘন্টা ধীরে বাজল তিনবার। শীতল বাতাসে ভেসে এলো এক প্রাচীন রীতি—যুদ্ধের ডাক।
লুম্বিনি পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে, চোখ তার অদৃশ্য শত্রুর দিকে। অগ্নিকন্যার ১২ সদস্যর একটি বাছাইকৃত দল প্রস্তুত। এরা কারও মা হারিয়েছে, কেউ ধর্ষিত হয়েছিল আগের বার্মিজ ক্যাম্পে, কেউবা কেবল বেঁচে ছিল প্রতিশোধের আশায়।
লক্ষ্য: শূন্য সেভেন-ডেল্টা পোস্ট। এক বিশেষ পোস্ট যেখানে বার্মিজ আর্মি এবং পরাজিত পাকিস্তানি গেরিলারা মিলে এক নতুন ‘মাইন ওয়ারহেড ট্রান্সফার পয়েন্ট’ বানিয়েছিল। এখানেই ছিল তাদের অস্ত্র মজুদের প্রাণকেন্দ্র।
মুন্না আগে থেকেই ড্রোনের সাহায্যে ভেতরের স্ট্রাকচার আঁকছিল। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে ডাবল গার্ড প্যাটার্ন, পালাক্রমে নিরাপত্তা পাল্টানো এবং আগ্নেয়াস্ত্র মজুদের সঠিক বিন্যাস।
“শুধু ঢুকে ধ্বংস না,” লুম্বিনি বলেছিল, “চিহ্ন রেখে আসবে—ওরা যেন জানে, নারীর রক্তকে হালকা ভাবার মূল্য কত।”
অপারেশন ‘অগ্নি-প্রলয়’ শুরু হয় রাত ১২:০৫ এ। সিলিন্সড স্টেনগান, হাতে তৈরি ইলেকট্রিক ডিসচার্জ ট্র্যাপ, এবং পাহাড়ি স্লিং—পুরো অভিযান ১৯৭১-এর আদলে কিন্তু ২০২৫-এর প্রযুক্তিতে।
একটি স্নাইপার পোস্টে রেজিনা, অগ্নিকন্যাদের সবচেয়ে তরুণ কেডার, নীরবে গুলি চালিয়ে ফেলে দেয় একজন হেড ইনচার্জকে। অন্যদিকে লুম্বিনি নিজ হাতে প্ল্যান্ট করে দেয় বিশেষ টাইমার ফিউজ—৫ মিনিটে ভেঙে পড়ে অস্ত্রভাণ্ডারের ছাদ।
পোস্টের বাইরে চুনকালি দিয়ে লেখা হয়—“আমরাই মেয়েরা, মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর।”
অভিযান শেষ হতে সময় লাগে ১৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড। কোন মৃত্যু নয়, কোন চিৎকার নয়—শুধু ছায়ায় এসেছিল, আগুন ছড়িয়ে গেছে, ছায়ায় মিলিয়ে গেছে।
ফেরার সময় মুন্না পাহাড়ের ওপর থেকে ক্যামেরা চালিয়ে রাখে। এবং সে দেখে, দূরের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে শূন্য সেভেন-ডেল্টা। আর উঠছে লাল ধোঁয়া, সূর্যোদয়ের আগে আগুনে আঁকা এক বিজয় সূর্য।
অধ্যায় ১৭: দুজনের একসাথে বাঁচার স্বপ্ন
অপারেশন ‘অগ্নি-প্রলয়’ সফল হয়েছে। শূন্য সেভেন-ডেল্টা এখন কেবল পোড়া ছাই, বার্মিজ-পাক শিবিরে আতঙ্ক। কিন্তু চন্দ্রপাহাড়ের অরণ্যে, এক পাহাড়ি ছড়ার ধারে, একটি বাঁশের ঘরে মুন্না আর লুম্বিনি চুপ করে বসে আছে।
মুন্নার ক্যামেরা বন্ধ। আজ সে শুধু চোখ দিয়ে দেখছে।
“সবসময় তো পালাতে চেয়েছো,” লুম্বিনি হেসে বলে, “আজ কেন থেমে আছো?”
মুন্না তার দিকে তাকায়—চোখে ক্লান্তি, কিন্তু গভীর ভালোবাসার ঝিলিক।
“কারণ এই যুদ্ধের মধ্যে তুমি একমাত্র সত্য,” সে বলে, “আর আমি চাই… যদি পারি, এই আগুনের মধ্যেই একটা ছোট্ট ঘর বানাই—তোমার আর আমার জন্য। পাহাড়ি ঝর্নার পাশে। সিগারেট ছাড়া, গোলাগুলি ছাড়া।”
লুম্বিনি চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে মুন্নার কাঁধে মাথা রাখে।
“আমি জানি, আমাদের চারপাশে শুধু ষড়যন্ত্র, মৃত্যু আর কাঁটাতার,” সে ফিসফিস করে, “কিন্তু আমি চাই… আমার মেয়েরা আর মরুক না। আমি চাই, তুমিও আর পালিও না।”
মুন্না তার হাত ধরে।
পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্য ওঠে। নতুন আলো ছুঁয়ে যায় তাদের মুখ। এই আলো রক্তে রঞ্জিত নয়, এই আলো জ্বলছে শুধুই সম্ভাবনায়।
একটা ঘর, একটা বাগান, কিছু বই, আর একটা জোছনা ভেজা উঠোন—যেখানে গেরিলা আর গুপ্তচর নয়, শুধু মানুষ আর ভালোবাসা বাস করে।
এই স্বপ্নটাই তারা দু’জনে এখন বুকে আঁকড়ে ধরে।
অধ্যায় ১৮: আত্মসমর্পণের পথে জোছনা ভেজা সন্ধ্যা
(অরণ্যের অন্ধকারে এক নতুন সকাল)
চন্দ্রপাহাড় ঘাঁটি ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। আগুনের বদলে উঠেছে শিশির, আর অস্ত্রের বদলে জ্বলছে পাহাড়ি আগর বাতির গন্ধ।
ঘরের ভেতরে অল্প আলো, হারিকেনের দপদপে শিখা, আর একটা বাঁশের মাচায় মুন্না আর লুম্বিনি পাশাপাশি শুয়ে।
লুম্বিনি তন্দ্রার মতো স্বরে বলে, “তুই কি জানিস মুন্না, এই যুদ্ধ শেষ হবার নয়?”
মুন্না ধীরে তার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “আমি জানি। তাই তো এবার পালাতে হবে। কিন্তু ভয়ে নয়—শান্তির সন্ধানে।”
দুজনে দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকে।
পাহাড়ের ওপারে কুয়াশা জমেছে। দূর থেকে শোনা যায় বাঁশির মতো এক পাখির ডাক। সময় যেন থেমে আছে, এই পাহাড়ি রাতের ভিতরে।
তারপর লুম্বিনি উঠে বসে। চোখে আগুন, কণ্ঠে ধাতব দৃঢ়তা—
“আমরা মিজোরামে যাব। আইজল। রাজধানী। প্রেসবিটারিয়ান চার্চের সামনে আত্মসমর্পণ করব। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে। যেন সবাই জানে—আমরা সন্ত্রাসী নই, বাঁচতে চাওয়া মানুষ।”
মুন্না হাসে।
“আইজলে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবি তুই, এক অগ্নিকন্যা? তুই তো আগুন!”
“আগুনও একদিন নিভে যায়। কিন্তু সে আলো রেখে যায়,” লুম্বিনি বলে।
তারা কাগজে আঁকতে থাকে রুট ম্যাপ।
চন্দ্রপাহাড় → তবলছড়ি → হাকালুকি গহীন খাল → বাউইথাং → মিজোরামের সীমান্ত ফাঁড়ি → আইজল।
মুন্না বলে, “এই পথে যেতে হলে ১৯৭১ সালের মতো সারভাইভাল টেকনিক লাগবে। আমি বাবার কাছ থেকে শিখেছি। খাদ্য গাছ, সাপ বিচ্ছু এড়িয়ে চলা, ঘুমের সময় সেন্স বাঁচিয়ে রাখা। একটাও ভুল চলবে না।”
লুম্বিনি ধীরে বলে, “যদি মরতে হয় পথে—তবে দুজন একসাথে।”
মুন্না চুপ করে থাকে।
তারপর মাটিতে রেখে দেওয়া ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে বলে—
“না, আমরা বাঁচব। আত্মসমর্পণের ছবি তুই ক্যামেরায় তুলবি। আমি পিছনে থাকব। ক্যামেরার পিছনে।”
পাহাড়ের ওপর উঠতে থাকে চাঁদের আলো। নিচে দুজন মানুষ, সারা শরীরে ঘাম, কাঁদা, যুদ্ধের দাগ।
তবুও একজোড়া হাত একে অপরকে আঁকড়ে ধরে।
তাদের শরীরের উত্তাপের ভেতরে এই যাত্রার সিদ্ধান্ত যেন হয়ে ওঠে বিদ্রোহ নয়, পুনর্জন্ম।
অধ্যায় ১৯: পাহাড়ি মৃত্যুকূপে, বৃষ্টির শব্দে নিঃশব্দ যাত্রা
(জীবনের জন্য পালানো আর মৃত্যুর কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলা)
চন্দ্রপাহাড় ঘাঁটি পেছনে ফেলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে অগ্নিকন্যা লুম্বিনি আর বোহেমিয়ান গুপ্তচর মুন্নার পদচারণা শুরু। সাথে নেই কোনো অস্ত্র—শুধু স্মৃতি, স্নেহ আর আত্মসমর্পণের সংকল্প।
বর্ষার মৌসুম। পাহাড় যেন জেগে উঠেছে বিশাল এক পশুর মতো। গাছের পাতায় টুপটাপ বৃষ্টি, মাটি কাদায় লুটোপুটি খায়। জোকে ভরা পথ, ঢলে নামা খাল, আর জঙ্গলের শব্দে নিঃশব্দ আতঙ্ক।
মুন্নার হাতে ছোট্ট একটি নকশা—একটা সেনা চৌকি পাশ কাটানোর রুট।
সেই রুটে পড়ে একটা পুরনো পরিত্যক্ত ট্রেইল—১৯৭১ সালে কর্নেল শামসুল হকের ব্যাটেল রুট, যেটা ব্যবহার করেছিল রাঙামাটি থেকে মিজোরাম ঢোকার সময়।
মুন্নার বাবা সেই দলের অংশ ছিলেন।
“এই রুটটা ওরা এখন ভুলেই গেছে,” মুন্না বলে।
কিন্তু ভুলে গেলেও মৃত্যু ওত পেতে থাকে।
রাত ২টা ৪৫ মিনিট।
পাহাড়ি পথের বাঁকে লুম্বিনি হঠাৎ থেমে যায়। তার চোখ পড়ে একটা পাতলা সুতোর মতো তারে—মাইন ট্রিগার লাইন।
“থাম!”—সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
মুন্না গা ঘেঁষে কাছে আসে। ধরা পড়ে এক মোটা সাইন—MBT-M7A1 মাইন, বার্মিজ আর্মির ফেলে যাওয়া।
এটা বিস্ফোরণ হলে ২০ মিটার ব্যাসার্ধে সবকিছু ছিন্নভিন্ন হবে।
মুন্না ফিসফিস করে—“আমাকে এক টুকরো বাঁশ দে। আমি ডিফিউজ করার চেষ্টা করি।”
তীব্র বাতাসে চুল ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টি থামছে না। লুম্বিনি অন্ধকারে ব্যাগ হাতড়ায়, একটা চিকন বাঁশ বের করে দেয়।
৫ মিনিটের নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে মুন্না ধীরে ধীরে ফিউজ ছেঁটে দেয়।
ক্লিক!
একটা শব্দ হয়, মনে হয় মৃত্যু এগিয়ে এল। কিন্তু কিছু হয় না।
মুন্না নিঃশ্বাস ছাড়ে।
“আর একটা ট্রিগার লাইন থাকলে?”—লুম্বিনি জিজ্ঞেস করে।
মুন্না কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “তাহলে আমাদের গল্প এই অধ্যায়েই শেষ হয়ে যেত।”
ভোর ৫টা নাগাদ তারা পৌঁছায় একটি পাহাড়ি ক্যানিয়ন—নিচ দিয়ে যায় সরু খাল, চারদিকে উঁচু গাছ আর ভেজা পাথর।
এইখানেই ছিল একটি অস্থায়ী বিডিআর চৌকি—এখন পরিত্যক্ত, কিন্তু কেউ নেই ধরে নেওয়া ভুল। হঠাৎই দূরে দেখা যায় আগুনের ছায়া, আর পাহাড়ি ভাষায় চেঁচানো—সেনা পেট্রল ইউনিট।
লুম্বিনি বলে, “ওরা পাহাড়ে টহল বাড়াচ্ছে। হয়তো আমাদের ক্যাম্প ধ্বংসের বদলা নিতে।”
মুন্না বলে, “তাহলে এখন থেকেই ছায়া হয়ে যেতে হবে।”
দুজনে পানির ভেতর দিয়ে হাঁটে, গায়ের কাপড় ভিজে একাকার।
চোখে ভয় নেই, শরীরে ক্লান্তি আছে—কিন্তু পায়ের গতি থেমে না।
কারণ তারা জানে—পেছনে আগুন, সামনে শুধুই আশ্রয়।
আর এই যাত্রা, যতই নিঃশব্দ হোক, সেটা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় শব্দ হয়ে থাকবে।
অধ্যায় ২০: আগুনের আঁচে, গুহার ঘুম
পথ হারানোর দ্বিতীয় দিন।
জুতা নেই, কাপড় ভেজা, কাঁধে জোঁক বসা। বৃষ্টির পানি কচুরিপানার ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
পাহাড়ের ঢালুতে এক পা পিছলে গেলে সহজেই মৃত্যু।
মুন্না আর লুম্বিনি—দুজনে ক্লান্ত, নিঃস্ব, আর নিঃশব্দ।
দিনের আলো হারিয়ে গেছে। রাতের তৃতীয় প্রহরে তারা বুঝতে পারে—তারা পথ ভুলেছে।
চন্দ্রপাহাড় ঘাঁটি থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে তারা এখন এক অজানা গিরিখাতে আটকে আছে। মাথার ওপরে হঠাৎ ভেসে ওঠে
চপার রোটারস-এর ঘূর্ণি শব্দ।
“উপর থেকে কেউ সার্ভেইল করছে। হাই অল্টিচ্যুড স্ক্যানার লাগানো চপার,” মুন্না নিচু স্বরে বলে।
দুজনে দৌড়ে ঢুকে পড়ে এক গুহার মতো অন্ধকার প্রকোষ্ঠে—পাথরের দেয়ালে শেওলা, ভিতরে ঠান্ডা আর ছত্রাকের গন্ধ।
“এটাই আজ রাতের বাড়ি,” লুম্বিনি বলে, শরীরটা মাটিতে ছেড়ে দেয়।
একটু পর বাইরে বেরিয়ে আসে মুন্না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিকে গাঢ় ধোঁয়াশা। তার বাম হাতে হাতে তৈরি তির, আর ডান হাতে বাঁশের সোজা শাফট।
নিশ্চুপে সরে গিয়ে ঘন ঝোপের মাঝে বসে থাকে। আধাঘণ্টা পর
একটা ছোট, তড়িৎ গতি সম্পন্ন খোরগোস (wild hare) সামনে দিয়ে ছুটে যায়।
ঝুপ!
তির ছুটে যায়। নিশানা ভোলে না।
মুন্না হাসে না, শুধু নিঃশ্বাস ছাড়ে।
গুহায় ফিরে এসে সে কাঠ জোগাড় করে ক্যাম্প ফায়ার জ্বালায়। পাথরের নিচে শুকনো কাঠ ছিল কিছু, গাছের শিকড়ের রস দিয়ে সে আগুন ধরায়।
খোরগোস ধীরে ধীরে জ্বলে, চর্বি গলতে থাকে। লুম্বিনি পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে, তার চোখে শুধু ক্লান্তি।
কিন্তু আগুনের আলোয় তাদের মুখ আবার ফিরে পায় কিছুটা রঙ।
মুন্না খোরগোসের ঠ্যাং ছিঁড়ে লুম্বিনির দিকে এগিয়ে দেয়।
“খা। বিপ্লবী হলে খাওয়া লাগে। আজ প্রেম নয়, শুধু প্রোটিন।”
লুম্বিনি কিছু না বলে হাত বাড়ায়। মুখে তুলে নেয় একটা ছোট টুকরো।
তারপর ধীরে বলে, “তুই না থাকলে আমি হয়তো আজ মরেই যেতাম।”
মুন্না বলে, “আমি আছি। কিন্তু আজ প্রেমিক হয়ে নয়—তোর সহযোদ্ধা হয়ে।”
পাহাড়ি রাতটা ঠান্ডা, গুহার ছাদ থেকে জলচোঁয়া পড়ছে। কিন্তু ক্যাম্প ফায়ারের আগুনে একধরনের উষ্ণতা।
সেই আগুনে রক্ত নেই, বিস্ফোরণ নেই—শুধু বেঁচে থাকার আকুতি।
মুন্না আর লুম্বিনি পাশাপাশি শুয়ে পড়ে মাটিতে পাতানো পাতা আর ভিজে জামাকাপড় বিছিয়ে।
নিঃশব্দে তারা চোখ বন্ধ করে।
চাঁদের আলো গুহার ফাটল গলে ঢুকে পড়ে তাদের ঘুমন্ত শরীরে—ঠিক যেন জীবন এখনো হারায়নি।
অধ্যায় ২১: বন্দি শিবিরের আগুন – সত্য, শরীর আর শাস্তি
(যেখানে স্বাধীনতা শব্দটা হারিয়ে যায় চামড়ার ভেতর)
গুহায় কাটানো সেই রাত যেন এক দুঃস্বপ্নের শান্ত মুহূর্ত।
সকাল হতেই দুজন আবার রওনা দেয় পূর্বমুখী—লক্ষ্য, আইজলের সীমান্ত। পাহাড় পেরিয়ে, ঘন বাঁশবন আর হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে।
কিন্তু…
মাত্র ৪ কিলোমিটার এগিয়ে, বাঁশঝাড়ের মধ্যখানে পা ফেলে মুন্না।
টিক
একটা চাপা শব্দ।
তারপর গুলির আওয়াজ—পক পক পক!
সাথে সাথেই ভেসে আসে ইংরেজি, মিজো, আর আরবি মিশ্রিত কণ্ঠ:
“DOWN! DOWN! HANDS WHERE WE CAN SEE!”
তারা পড়ে যায় মাটিতে। চারদিক থেকে বেরিয়ে আসে কালো মুখোশ পরা সশস্ত্র লোক, পিঠে “PMC: Black Tiger Unit” লেখা। আন্তর্জাতিক কনট্রাক্ট মিলিটারি। এদের আর্থিক পেছনে রয়েছে তেল-বাণিজ্যিক শক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক লগ্নি।
লুম্বিনির গালে লাথি মারে একজন।
মুন্নাকে চোখ বেঁধে ফেলে।
**
বন্দি শিবির।
স্থান: অজানা।
একটি জীর্ণ বাঁশের ঘর, সিলিন্ডার জ্বালানো আলো, দেয়ালে ঝুলছে বৈদ্যুতিক তার। পাশে বাঁধা একটি জলসেচ পাম্প—কিন্তু তা দিয়ে *জল
অধ্যায় ২২: ছায়ার কারখানা – খনিজের নিচে রক্তের গন্ধ
(যেখানে প্রেম বন্দি, শরীর পণ্য, আর জীবন একটি খনির দরজার ওপারে)
মুন্না আর লুম্বিনির চোখ বাঁধা।
জ্ঞান ফিরতেই তারা আবিষ্কার করে—তারা বন্দি একটি অদ্ভুত, দূরবর্তী ‘খনি শিবিরে’।
এটা কোনো রাষ্ট্রের মানচিত্রে নেই।
এখানে নেই জাতিসংঘের আইন।
এখানে কেবল রয়েছে খনিজ, গোপন সুড়ঙ্গ, আধা-স্বয়ংক্রিয় মেশিনারি,
আর চামড়া ছিঁড়ে ফেলার মতো নির্যাতন।
এরা মিলিশিয়া নয়, এরা দৈত্যরা, যাদের জন্য খনিজ সম্পদ আহরণ নেশা, আর প্রতিরোধকারী দমন করা পেশা।
PMC Black Tiger Unit নামে এই আন্তর্জাতিক কনট্রাক্ট মিলিশিয়া গোষ্ঠী — রাশিয়া, চীন, আরব, পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অপরাধ সিন্ডিকেটের যৌথ মুনাফাভোগী।
তাদের শিকারে এখন মুন্না ও লুম্বিনি।
৬ দিন, ৬ রাত — মৃত্যু নয়, মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর কিছু:
প্রথম দিন— তাদের আলাদা করে ফেলা হয়।
মুন্নাকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বেত দিয়ে তৈরি ম্যানুয়াল স্ট্রেচিং র্যাকে। বিদ্যুৎচালিত চেইনে একটানা জিজ্ঞাসাবাদ—
“তুমি কার হয়ে কাজ করো?”
“তুমি সাংবাদিক? গুপ্তচর? ভারতের এজেন্ট?”
সে কিছুই বলে না।
লুম্বিনিকে আটকে রাখা হয় একটি লোহার ঘরে, যেখান থেকে ক্রমাগত শোনা যায় করাতের শব্দ, মানুষের আর্তনাদ, আর ‘টেস্টিং’-এর নাম করে নারীদের গায়ে তরল আগুন ঢালার দগ্ধ গন্ধ।
দ্বিতীয় দিন— লুম্বিনির উপর চালানো হয় মানসিক খেলা। তাকে দেখানো হয় মুন্নার রক্তাক্ত ছবি। বলা হয়, মুন্না সব স্বীকার করে ফেলেছে।
তার চোখে তখন শুধু একটাই উত্তর—
“মুন্না মরে যাবে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হবে না।”
তৃতীয় দিন— তাদের সামনে নিয়ে আসা হয় একটি ছেলেকে—এক পাহাড়ি বালক, যার পরিবারকে হত্যা করে এই মিলিশিয়া তাদের ক্যাম্পে কাজ করায়।
তাকে দিয়ে মুন্নার ওপর বেঁধে ছুঁড়ে মারা হয় পাথর—“তুমি সন্ত্রাসী। তুমি আমার গ্রামের আগুন।”
মুন্নার চোখে জল আসে, কিন্তু সে তাকিয়ে থাকে ছেলের চোখে—
ভালোবাসা দিয়ে, ঘৃণা দিয়ে নয়।
চতুর্থ রাত— লুম্বিনিকে অপমানিত করা হয়। তার মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়, গায়ে তুলে দেওয়া হয় রাবার স্যুট, শরীরে ফেলে দেওয়া হয় ঠান্ডা এসিড বাষ্প, যেন এক ধরণের স্লো টর্চার।
তবে সে চিৎকার করে না।
পঞ্চম দিন— মুন্নার পায়ে চালানো হয় ‘নেইল-পুল’ — নখ তুলে নেওয়ার যন্ত্র।
আরও একবার জিজ্ঞেস করা হয়, “তোমার ক্যামেরার ফুটেজ কোথায়? তুমি জাতিসংঘে কী নিয়ে যেতে চেয়েছিলে?”
সে থুতু ফেলে দেয় জিজ্ঞাসাবাদের চেয়ারে।
ষষ্ঠ রাত— তারা দু’জনকে আবার একসাথে ফেলে রাখা হয় একই কনটেইনারে।
ঘরে আলো নেই।
তারা কেবল একে অন্যের নিঃশ্বাস শুনতে পায়।
লুম্বিনি ফিসফিস করে, “তুই আছিস?”
মুন্না বলে, “আমি তোকে ছাড়া মরতে পারি না। তাই বেঁচে আছি।”
তারপরে দুজনে চুপচাপ হাত ধরে বসে থাকে অন্ধকারে।
শরীরে যত যন্ত্রণা থাকুক, সে রাত ছিল অন্যরকম—
তাদের হৃদয়ের স্পন্দন যেন একমাত্র উত্তর দেয়—
“আমরা এখনো জীবিত।”
অধ্যায় ২৩: ভাগ্যের নাম পাহাড়ি ছেলেটা
(অন্ধকার খনির পেটে এক টুকরো আলো)
ষষ্ঠ রাত। গায়ে নখ নেই, চামড়ায় ছ্যাঁকা, মুখে রক্ত, আর চোখে শুধু ছায়া।
লুম্বিনি ও মুন্না শুয়ে আছে কনটেইনারের কনক্রিটে। নীরব, নিস্তব্ধ, কিন্তু ভাঙেনি।
হঠাৎ পায়ের কাছে একটা শব্দ হয়—মৃদু ঠক ঠক।
লুম্বিনি সতর্ক হয়। মুন্না উঠে বসে।
একটা স্লিপিং ব্যাগের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ১৫-১৬ বছরের এক পাহাড়ি কিশোর। গায়ের রঙ পাথরের মতো, চোখ তীব্র চকচকে।
সে ফিসফিস করে বলে—
“আমি আপনাদের ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছি। ওরা যা করে এখানে… আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
মুন্না ফিসফিসায়, “তুই কে?”
“আমার নাম রামথাংগা। মা-বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি ওদের খনিতে কাজ করি… কিন্তু আমি জানি একটা গোপন প্যাসেজ, যা সরাসরি যায় পুরনো মিজো পাচার রুট দিয়ে। ওখান দিয়ে যেতে পারলে… আইজল মাত্র দুই দিনের পথ।”
লুম্বিনির চোখ ভিজে আসে। মুন্না হাত বাড়িয়ে দেয়।
“তুই যদি সত্যি সাহায্য করিস… তাহলে আমরা শুধু পালাব না। এইসব পশুদের মুখোশ খুলে দুনিয়াকে দেখাব।”
ছেলেটা বলে—
“তাই তো চাই আমি… আমার ভাইয়ের বদলা নিতে চাই।”
রাত তিনটায় বিদ্যুৎ যায়। সিকিউরিটি ক্যামেরা কাজ করে না।
রামথাংগা দুজনকে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে, ক্যারিয়ার শ্রমিক সাজিয়ে বের করে আনে পশ্চিম শেডের পেছনের রাস্তা দিয়ে।
মুখে কয়লার ছোপ, মাথায় হেলমেট, হাতে এক বোতল রক্তমাখা কেরোসিন।
পাহাড়ি পাথরের গায়ে লুকানো একটা খোলা ফাটল—সেটাই পুরনো পাচার রুট।
ঘণ্টাখানেক হামাগুড়ি দিয়ে, আঁধারে রক্ত আর ঘাম মিশিয়ে, তারা ঢুকে পড়ে সেই করিডোরে।
পিছনে মিলিশিয়া বাহিনীর হা হা শব্দ, সামনে গর্জে ওঠা জঙ্গলের গর্জন।
কিন্তু ভয় আর বাঁধে না।
মুন্না তার হাতটা ধরে রাখে, যেন ভেঙে না পড়ে লুম্বিনি।
আর লুম্বিনি পেছনে তাকিয়ে বলে,
“এই দুনিয়া জানবে—নারীর প্রতিরোধ কেমন হয়।”
দুইদিন ধরে টানা পাহাড়ি ট্রেইল, বাঁশঝাড়, ভাঙা সেতু পার হয়ে, তৃতীয় দিনে সূর্য ওঠার সময় দূরে দেখা যায়—
“Welcome to Aizawl – Mizoram State Capital”
একটা সাইনবোর্ড।
মুন্না পড়ে যায় হাঁটু গেড়ে। চিৎকার করে না। শুধু নিঃশব্দে হাসে।
লুম্বিনি তার পাশে বসে। তার চোখে জল, কিন্তু সে বলে—
“এখন আত্মসমর্পণ নয়।
এখন সত্য উন্মোচনের সময়।”
রামথাংগা কাঁধে মুন্নার ক্যামেরা ব্যাগটা তুলে দেয়।
“এই ছবি বদলে দেবে ইতিহাস।
অধ্যায় ২৫: জোছনায় বিলীন—যেখানে তারা শুধুই মানুষ
আইজলে এখন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, প্রেসের গুঞ্জন, আন্তর্জাতিক কূটনীতির শোরগোল।
কিন্তু এক কোণে, ভোরের কুয়াশায় মুন্না দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের বারান্দায়, পাশে লুম্বিনি।
সামনে ডানকান পাহাড়ের মাথা রুপোলি হয়ে গেছে।
রামথাংগা ঘুমিয়ে।
কিন্তু তাদের চোখে আর ঘুম নেই।
“তুই জানিস লুম্বিনি, আমাদের ক্যামেরা এখন যুদ্ধের অস্ত্র,” মুন্না ফিসফিস করে।
“হ্যাঁ,” লুম্বিনি উত্তর দেয়, “কিন্তু আমিও চাই এখন শুধু একটু ঘুম, একটু শান্তি। তোকে ছাড়া নয়, তোকে নিয়েই—মানুষ হয়ে বাঁচার চেষ্টা।”
সেই রাতে তারা দুজন ব্যাকপ্যাক কাঁধে বেরিয়ে যায় হোটেলের পেছনের গেট দিয়ে।
কোনও সাংবাদিক দেখে না, কোনও নিরাপত্তা জিজ্ঞেস করে না।
তারা হেঁটে যায় মিজোরামের পাথুরে পথ ধরে,
যেখানে না আছে সম্মান, না আছে শিরোনাম—
শুধু আছে জীবন।
তারা ঢুকে পড়ে এক পাহাড়ি জনপদে, নাম—সেরছিপ।
একটি বৃদ্ধা তাদের আশ্রয় দেয়।
মুন্না চাষের কাজে লেগে যায়।
লুম্বিনি শিশুশিক্ষায় যোগ দেয় ছোট্ট এক স্কুলে।
তারা নাম পাল্টায়। পরিচয় লুকায় না—প্রকাশ করে না।
তারা সুখে থাকে না—শান্তিতে থাকে।
এক রাতে, জোছনার আলোয় লুম্বিনি বলে—
“তুই এখনো আমাকে ভালোবাসিস?”
“তুই থাকিস বলেই আমি বেঁচে আছি,” মুন্না বলে।
তারা দুজন জানে—বিশ্ব এখনো নড়ছে, যুদ্ধ থামেনি, ক্যামেরা গুনছে সংবেদন।
কিন্তু তারা আর সেই ছবির অংশ হতে চায় না।
তারা শুধু চায়, প্রতিদিন একটু করে মানুষ হয়ে উঠতে।
একটা জোছনার রাতে, তারা দুজন একে অপরের গায়ে মাথা রেখে, পাহাড়ের ঢালে চুপচাপ বসে থাকে।
কোনও ডাক নেই, কোনও সংবাদ নেই।
শুধু একটা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,
আর বাতাসে ভেসে আসে সেই পুরোনো লাইনটা—
“চেলতে চেলতে মেরি ইয়ে গিত ইয়াদ রাখনা… কভি আলবিদা না কেহেনা…”
(সমাপ্ত)